আজ আমরা জানবো ভেনেজুয়েলা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন নিয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটন থেকে কারাকাসের প্রতি কঠোর ভাষায় একের পর এক হুশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। কেন এই উত্তেজনা? এর পেছনে ভূ-রাজনীতি, তেল, এবং আন্তর্জাতিক জোট কতটা বড় ভূমিকা রাখছে? চলুন ধাপে ধাপে জেনে নেই।
ভেনেজুয়েলা- লাতিন আমেরিকার এক গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বিশাল তেল মজুদের জন্য একে বলা হয় “কালো সোনার ভাণ্ডার”। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা শক্তির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ বারবার ভেনেজুয়েলাকে হুশিয়ারি দিচ্ছে?
১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভেনেজুয়েলা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন অবস্থান নিতে শুরু করে। তিনি সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করেন, আমেরিকার আধিপত্য মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং রাশিয়া, চীন, ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন।চাভেজের মৃত্যুর পর নিকোলাস মাদুরো একই পথ অনুসরণ করেন। কিন্তু তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ভয়াবহ রূপ নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুবার মাদুরো সরকারকে “অবৈধ শাসন” বলে অভিহিত করেছে। ২০১৯ সালে ওয়াশিংটন সরাসরি বিরোধীদলীয় নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।একই সঙ্গে আমেরিকা ভেনেজুয়েলার ওপর কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, বিশেষত তেল রপ্তানির ওপর। এই নিষেধাজ্ঞায় ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু সরকার টিকে আছে রাশিয়া, চীন ও ইরানের সহায়তায়।
তাহলে প্রশ্ন- সাম্প্রতিক হুশিয়ারির পেছনে আসল কারণ কী?
ভূ-রাজনীতি: ভেনেজুয়েলা রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করছে। মস্কোর যুদ্ধবিমান ও সামরিক উপদেষ্টারা কারাকাসে অবস্থান করছে বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমে খবর এসেছে।
তেল ও জ্বালানি: ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণিত তেল ভাণ্ডারের মালিক। আমেরিকা আশঙ্কা করে, যদি এই সম্পদ রাশিয়া বা চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তবে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
আঞ্চলিক প্রভাব: কিউবা, নিকারাগুয়া এবং বলিভিয়ার মতো দেশগুলো ভেনেজুয়েলার পাশে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে গর্ব করে। এদের রয়েছে হাজার হাজার যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক অস্ত্র, এবং এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার।অন্যদিকে ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও, তারা রাশিয়ান তৈরি S-300 ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক যুদ্ধবিমান ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করছে।তবে সামরিক শক্তির এই বৈষম্য ভেনেজুয়েলাকে সহজ লক্ষ্য বানালেও, ভৌগোলিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সমর্থন এটিকে জটিল করে তুলেছে।
ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক বার্তায় স্পষ্ট বলা হয়েছে- ভেনেজুয়েলা যদি রাশিয়া বা ইরানের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়, তবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
আমেরিকার কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট মাদুরো পাল্টা হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন- “ভেনেজুয়েলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমরা কারও ভয় করি না। আমাদের তেল, আমাদের মাটি, আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জনগণ সর্বদা প্রস্তুত।”তিনি আরও বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেশের জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তবে ভেনেজুয়েলা বিকল্প বাজার খুঁজে নিচ্ছে।
✦ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
রাশিয়া: কারাকাসকে সমর্থন জানিয়ে বলেছে, ভেনেজুয়েলার ওপর মার্কিন হুমকি অগ্রহণযোগ্য।
চীন: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে কথা বলেছে, একই সঙ্গে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য জোরদার করছে।
জাতিসংঘ: শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে, তবে বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষ।খাদ্য সংকট, ওষুধের অভাব, এবং কর্মসংস্থানের অভাবে লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী কলম্বিয়া, ব্রাজিল, এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকায় শরণার্থী হয়ে পাড়ি জমাচ্ছে।একই সময়ে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার টানাপোড়েন আরও বাড়ে, তবে লাতিন আমেরিকা হয়ে উঠতে পারে নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধের মঞ্চ। ভেনেজুয়েলা রাশিয়া ও চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠছে, আর আমেরিকা তাদের প্রভাব ঠেকাতে মরিয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই দ্বন্দ্ব কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান হবে, নাকি রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে যাবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন