ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে সংঘর্ষ বহু বছর ধরে চলে আসছে, এবং এটি কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত ব্যাপক আলোচনার বিষয়। তবে কাতারের ভূমিকা এবং এর সাথে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের সম্পর্ক নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।
কাতার, একটি মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ, ২০০০ সালের পর থেকে প্যালেস্টাইনের প্রতি এক ধরনের শক্তিশালী সমর্থন প্রদান করে আসছে। কাতার প্যালেস্টাইনের জনগণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে, এবং গাজার একটি প্রধান সাহায্যকারী হিসেবে পরিচিত। এটি গাজার শাসক গোষ্ঠী হামাসের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং তাদেরকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়েছে।
হামাস হল একটি ইসলামিক রাজনৈতিক সংগঠন এবং যুদ্ধাগ্রস্ত গাজা অঞ্চলের শাসক গোষ্ঠী। ২০০৭ সাল থেকে তারা গাজা নিয়ন্ত্রণ করছে, যা প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীর থেকে আলাদা। হামাস ইসরায়েলকে একটি অবৈধ রাষ্ট্র মনে করে এবং তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কাতার হামাসের প্রতি তার সমর্থন বজায় রেখেছে, যার ফলে ইসরায়েল এবং কাতারের মধ্যে তীব্র সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও কাতার হামাসকে সমর্থন দেয়, তবে তারা বহুবার শান্তির জন্য মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে। কাতার সর্বদা এই সংঘর্ষের সমাধানে একটি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সমর্থন করে এসেছে, যেখানে প্যালেস্টাইন এবং ইসরায়েল দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করবে। কাতার যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে একযোগে শান্তির উদ্যোগের পক্ষে।
ইসরায়েল এবং কাতারের মধ্যে সম্পর্ক খুবই জটিল। যদিও কাতার প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়িয়েছে, তবে তা সরাসরি ইসরায়েলকে বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে কখনোই পুরোপুরি এগিয়ে যায়নি। কাতার কখনোই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি বা তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে হামলা করেনি। বরং তারা অনেক সময় প্যালেস্টাইনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তির আলোচনায় অবদান রেখেছে।
বর্তমানে, কাতার এবং ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনা কম। কাতারের একটি কৌশল হল নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক মহলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের ভূমিকা শক্তিশালী করা। কাতার জানে যে, শুধুমাত্র প্যালেস্টাইনের প্রতি সহায়তা দিলেই সমাধান আসবে না, বরং ইসরায়েল এবং অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে শান্তির দিকে এগোতে হবে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি বিমান বাহিনী কাতারে আশ্রয়প্রাপ্ত হামাসের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে দোহার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে হামলা চালায়। এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল হামাসের বর্তমান শীর্ষ নির্বাহী খলিল আল হায়া এবং গোষ্ঠীটির অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতা। মাত্র ১৫ মিনিট স্থায়ী হওয়া সেই অভিযানে দোহায় হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচজনসহ মোট ছয়জন নিহত হলেও সৌভাগ্যবশত বেঁচে যান খলিল আল হায়া এবং হামাসের হাইকমান্ডের সদস্যরা। এই ঘটনায় বিশ্বের প্রায় সব দেশ ইসরায়েলের নিন্দা জানায়। তবে ১৫ সেপ্টেম্বর ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ট্রাম্প বলেন, 'নেতানিয়াহু আর কাতারে হামলার নির্দেশ দেবেন না। কাতার আমাদের খুবই ভালো মিত্র। অনেকেই এটি জানেন না, কিন্তু তিনি (নেতানিয়াহু) ভবিষ্যতে কখনো কাতারে হামলা করার নির্দেশ দেবেন না। এখন থেকে তিনি কাতারের সঙ্গে মিলেমিশে চলবেন।'
এই হামলার পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এবং রাজনৈতিক কারণ ছিল।
কাতার দীর্ঘদিন ধরে হামাসকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে। যদিও কাতার কখনো সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি, কিন্তু তারা হামাসকে মানবিক সহায়তা প্রদান এবং রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার কারণে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এটি তাদের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখছে।
কাতারের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর আরেকটি কারণ হতে পারে হামাসের সামরিক কর্মকাণ্ডের দিকে ইসরায়েলের নজর রাখা। গাজার বিভিন্ন যুদ্ধপরিস্থিতি, বিশেষ করে রকেট হামলা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম ইসরায়েলের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ হামাসের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বা সংলাপ করার কোনো ইচ্ছা রাখে না। তারা হামাসকে তাদের অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি মনে করে, কারণ হামাস ইসরায়েলকে "অবৈধ রাষ্ট্র" হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাদের লক্ষ্য ইসরায়েলকে ধ্বংস করা।
কোনো শত্রু গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা করা সামরিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে, যার মাধ্যমে গোষ্ঠীটির নেতৃত্ব এবং কার্যক্রম ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়।
ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর দোহার হামলা, কাতারে হামাসের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত আক্রমণ ছিল, যা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পদক্ষেপ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। কাতারে হামাসের নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ, ইসরায়েলের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করে এবং তারা এটি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। এই হামলা তাদের পক্ষ থেকে এক ধরনের বার্তা ছিল, যা তাদের বিরোধী শিবিরকে জানান দেয় যে, তারা যেকোনো জায়গাতেই হামাসের নেতাদের টার্গেট করবে।
এ ধরনের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক বাস্তবতা এবং ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের আরও এক জটিল অধ্যায় হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন